Saturday, 8 June 2013

একটি জাহানারার গল্প...

১৯৭৬ সালঃ বরগুনা জেলার ছোটবগি নামের ছোট একটি গ্রামে মোটামুটি সচ্ছল পরিবারের ১৭ বছর বয়সী কিশোরী জাহানারা ইসলামের বিয়ে হয় সদ্য চাকুরি পাওয়া ইঞ্জিনিয়ার নুরুল ইসলাম নামের ২৩ বছরের এক যুবকের সাথে। বর্তমান সময়ে যা বাল্যবিবাহ বলেই বিবেচিত হবে কিন্তু তৎকালীন সময়ে এটাই স্বাভাবিক ছিল। বিয়ের সময় জাহানারা সদ্য নবম শ্রেণী তে উঠেছে।

বিয়ে, বাড়ির বড় ছেলের বউ, সংসার, স্বামীর বদলির চাকরি সবকিছু মিলিয়ে জাহানারার লেখাপড়ার ইচ্ছা শক্তি হারিয়ে যায়। অনেক বার দেবর দের সাথে চেষ্টা করেও তার লেখাপড়া আর হয়ে ওঠে না।

১৯৮০ সালঃ প্রথম সন্তানের মা হয় জাহানারা। প্রথম সন্তান হিসেবে মেয়ে বাচ্চা হলেও স্বামী শ্বশুর বাড়ির লোকজনের সহযোগিতা সে হারায়নি। বরং সবাই এটাকে স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নেয়। 

১৯৮২ সালঃ এবার জাহানারা দ্বিতীয় সন্তানের মা হয়। ছেলেটা দেখতে পুরোপুরি জাহানারার বাবা এর মত।

১৯৮৪ সালঃ ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে জাহানারার বাবা সে বছর মারা যায়। কষ্ট পায় সে অনেক কিন্তু ছেলে তো দেখতে তার বাবার মত তাই সে কষ্ট টাও একদিন ভুলে যায়।

১৯৮৯ সালঃ দুই বাচ্চা, স্বামী নিয়ে জাহানারার সুখের সংসার তবুও কিসের জানি বড্ডও অভাব ছিল। তৃতীয় বারের মত মা হয় জাহানারা। ছেলেটা বড়ই বাঁদর কিসিমের। জন্মের সময়ই মেরে ফেলতে নিয়েছিল কিন্তু আল্লাহর অশেষ কৃপায় সে বাচ্চা সহ দিব্যি বেচেও যায় জাহানারা।

ইতিমধ্যে জাহানারা বেশ অনেক জায়গায় ঘুরেছে স্বামীর বদলির চাকরীর সুবাদে।

১৯৯৪ সালঃ অনেক গোপনীয়তা বজায় রেখে সমাজের চক্ষু ফাকি দিয়ে জাহানারা বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে মাধ্যমিক পরিক্ষার জন্য নবম শ্রেণীতে ভর্তি হয়। স্বামী ও ছোট ছেলেটাকে নিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে প্রত্যেক শুক্রবারে সে যায় ক্লাস করতে। ভালই চলে তার ক্লাস করা।

১৯৯৬ সালঃ জাহানারার বড় মেয়ে এবার এসএসসি পরিক্ষা দিবে। বরাবরই বিশাল প্রত্যাশা। প্রত্যাশা অনুযায়ী ফল ও হলও। জাহানারার মেয়ে সমগ্র ঠাকুরগাঁ জেলায় প্রথম হয়েছে। মজার ব্যাপার হলো জাহানারাও সেবার  উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে  এসএসসি পরিক্ষা দিয়েছিল। উল্লেখ্য যে জাহানারাও সমগ্র ঠাকুরগাঁ জেলায় প্রথম বিভাগ পেয়ে প্রথম হয়েছে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার্থীদের মধ্যে। 

জাহানারার স্বামী এবার ঢাকা বদলি হল। এসএসসি এর পর বুঝি আর লেখাপড়া হবে না সে আশঙ্কা দেখা দিল। কিন্তু সে হাল ছাড়ল না। এইচএসসি তে সে ভর্তি হল, কিন্তু লেখাপড়া যে অনেক কঠিন এখন। 

২০০১ সালঃ জাহানারার বড় ছেলে এবার এইচএসসি পরিক্ষা দিবে। সাথে জাহানারাও পরিক্ষা দিবে  উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ছেলে প্রথম বিভাগে পাস করলেও জাহানারা কে এবার তৃতীয় বিভাগেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। যাক বাবা অনেক পড়াশুনা হয়েছে আর দরকার নাই এরকম একটা ভাব।

এরমধ্যে জাহানারার স্বামী আবার বগুড়া বদলি হয়। স্বামীর হার্ট এর প্রবলেম সহ অনেক শারিরিক অসুস্থতায় সে লেখাপড়ার কথা ভুলে গিয়েছে বলেই মনে হয়।

২০০৭ সালঃ জাহানারার ছোট্ট ছেলেটা সেইবার এইচএসসি পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে। এমন সময় জাহানারার বড় মেয়ে তাকে খোজ দিল যে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি তে ইসলামী ইতিহাসে দুরশিক্ষনে অনার্স করা যায়। যেই কথা সেই কাজ। ছেলে ভর্তি হল ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে আর মা এশিয়ান ইউনিভার্সিটিতে। উল্লেখ্য যে এবছরই জাহানারা নানি হয়েছে। তার মেয়ের ঘর আলো করে তার নাতনি যারা মুমতাহানা ইসলাম এর আগমন হয়েছে।  

তারপর প্রতি শুক্রবার ঘর সংসার ফেলে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত চলে জাহানারার ক্লাস করা। এক সময় সে অনার্স পাস করেও ফেলে প্রথম বিভাগে। অতঃপর সে মাস্টার্সেও সে ভর্তি হয়। প্রথম বিভাগ পেয়ে সে মাস্টার্সও পাস করে।

২০১২ সালঃ জাহানারার ছোট্ট ছেলে টা বিবিএ পাস করে সমাবর্তনে অংশ নিচ্ছে। মা হিসেবে সে যথেষ্ট গর্বিত সে সেখানে উপস্থিত থেকে। উল্লেখ্য যে জাহানারার বড় দুই সন্তান অনেক বেরসিক, তারা পাবলিক   বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডাক্তারি ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেও কেউ সমাবর্তন নেন নাই। 

২০__ সালঃ জাহানারার আজ সমাবর্তন। নাতনির হাত ধরে সে আজ সমাবর্তন নিতে এসেছে। জাহানারা মঞ্চের দিকে এগুচ্ছে তার সনদ সংগ্রহের জন্য। সে দৃশ্য অবাক হয়ে দেখছে জাহানারার স্বামী নুরুল ইসলাম, মেয়ে রিক্তা, দুই ছেলে নাজমুল আর জাহিদ। নাতনি হঠাৎ আঁচল ধরে টান দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, নানু ওরা কি কাদছে? জাহানারা নির্বাক তাকিয়ে একটা হাসি দিল, আজ সে কিছু বলবে নাহ কাওকে।

উপরোক্ত গল্পের সবটুকুই সত্য, শুধুমাত্র শেষ প্যারা টা কাল্পনিক।

5 comments:

  1. Proud of u bro......son of a genius mom...

    ReplyDelete
  2. Dosto... golpo ta tor thekei shunsilam but khub shundor kore likhsish.... pore chokhe pani chole ashche re!! Aunty along with all of your family members ke amar salute!!! Aunty rocks!

    ReplyDelete
  3. Ma ra je kibhabe etto koshto shojjo kore..she is a wonder woman,no doubt & you expressed it beautifully!@

    ReplyDelete
  4. সত্যি কথা বলতে কি, লেখাটা পড়েই কিন্তু আন্দাজ করা যাচ্ছে যে তাকে কতটা স্ট্রাগ্যেল করতে হয়েছে...... তাকে উদ্দেশ্য করে শুধু একটা কথাই বলতে চাই, "মা", হ্যাটস অফ!!

    ReplyDelete
    Replies
    1. অনেক কষ্ট করেছে আম্মু এবং আব্বুর অবদান ও কিন্তু কম নাহ। আমার মনে আছে আব্বু অবসর গ্রহনের পর আম্মুর এসাইনমেনট করে দিত।

      Delete